যেভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, আলজাজিরা, গার্ডিয়ানের মতো সংবাদমাধ্যমে এ আন্দোলনের কারণ এবং এর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

বুধবার বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারবিরোধী বিক্ষোভের ফলে বাংলাদেশে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরমধ্যে দেশব্যাপী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত ১৫০ জন নিহত হয়েছে। রক্তপাতের মধ্যে আটকে পড়াদের মধ্যে কেউ কেউবিবিসিকে ঘটনা বর্ণনা করেন।

একজন শিক্ষার্থী বলেন, রাজধানীতে বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চেয়েছিল। তবে পুলিশ হামলা চালিয়েসবকিছুবরবাদকরে দেয়।

আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বর্ণনা করেছেন, কীভাবে পুলিশ পরিচয় দেওয়া লোকেরা তাঁকে তুলে নিয়েচোখ বেঁধে নির্যাতন করেছে। 

এদিকে ঢাকায় জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেছেন, সংঘর্ষের চরম সময়ে এত বেশি আহত যুবককে আনা হয় যে, তারা বিস্মিত হন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ থাকলেও অস্থিরতার জন্যসরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের দায়ী করেছে। 

গত জানুয়ারিতে দেশটির প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জন করা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায়আসার পর এবারের সহিংসতা দলটির জন্য সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রায়া (আসল নাম নয়) বিবিসিকে বলেন, ১৭ জুলাই বুধবার তিনি প্রথম বিক্ষোভে যোগদিয়েছিলেন। কিন্তু পরের দিনই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষসত্যিই ভয়াবহহয়ে ওঠে। পুলিশ বেলা সাড়ে ১১টার পর শিক্ষার্থীদেরওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে হামলা চালায়। সেই মুহূর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই টিয়ার গ্যাসের শেলগুলো তুলেনিয়ে পুলিশ সদস্যদের দিকে ছুড়ে মারে। তিনি বলেন, পুলিশ পরে রাবার বুলেট ব্যবহার শুরু করে এবং এক পর্যায়েশিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে আটকে রাখে, এমনকি গুরুতর আহতদের হাসপাতালে নিতেও বাধা দেয়।

বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাথর নিক্ষেপ করে। জবাবে পুলিশ শটগানের গুলি, টিয়ার গ্যাস এবং সাউন্ডগ্রেনেড ছুড়েছে। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালানো হয়। 

বিবিসির সাংবাদিকরা সর্বত্র আগুন দেখতে পেয়েছেন। রাস্তায় পড়ে ছিল পোড়া ভাঙচুর করা যানবাহন। দেখেছেন পুলিশএবং বিক্ষোভকারীদের স্থাপন করা ব্যারিকেড। পুলিশকে ফোর্স পাঠাতে এবং গোলাবারুদ চাইতে দেখা যায়। এই সময়েরমধ্যে শহরের হাসপাতালগুলোতে বিপুলসংখ্যক আহতদের আনা হয়। অনেকেই রক্তে ভেজা হেঁটে এসেছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেছেন, কয়েক ঘণ্টা ধরে মিনিটে মিনিটেআহতরা আসেন। বেশির ভাগ রোগীই ছিল গুলিবিদ্ধ। বৃহস্পতিবার ছয় ঘণ্টার শিফটে তারা ৩০টি অস্ত্রোপচার করেন।

বিবিসি বলছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় সরকার দেশব্যাপী কারফিউ ঘোষণা এবং রাস্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে পরিস্থিতিআরও খারাপ হয়।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তার কর্তৃত্বকে গভীরভাবে বিস্তৃত করেছে এবং১৭ কোটি মানুষের এই দেশকে বিভক্ত করেছে। সরকার তার অনুগতদের পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতা এবং দায়মুক্তি দিয়ে পুরস্কৃতকরেছে। অন্যদিকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনপীড়ন, সীমাহীন আইনি জটলা এবং কারাবাসের সম্মুখীন হতে হয়েছে।সরকারের রক্তাক্ত ক্র্যাকডাউনে কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত হয়েছে। 

পত্রিকাটি বলছে, ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ কোটার বিরোধিতায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল। তবে নিরাপত্তাবাহিনী এবং সরকারি দলের সহিংস প্রতিক্রিয়া দেশকে নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। 

কূটনীতিকরা এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে মারাত্মক রাজনৈতিক সহিংসতার পর্যাপ্ত ইতিহাস থাকলেও এমননৃশংসতা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেশটিতে নজিরবিহীন। অনেক বাংলাদেশির কাছে, এখানে সীমারেখা অতিক্রম করাহয়েছে। পরিস্থিতি শিগগির কমবে বলে মনে হচ্ছে না।

কূটনীতিক এবং কর্মকর্তারা বলছেন, ১৫০ জন নিহতের সংখ্যা একটি রক্ষণশীল হিসেবে। স্থানীয় সংবাদপত্র বলছে, মৃত্যুরসংখ্যা ২০০এর কাছাকাছি। আন্দোলনের নেতারা বলছেন, নিহতের সংখ্যা সম্ভবত তার কয়েক গুণ। 

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ছাত্রনেতারা অভিযোগ করেছেন, বিক্ষোভের ওপর সহিংস পুলিশিদমনপীড়নের সময় তাদের অপহরণ এবং নির্যাতন করা হয়। 

ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের অভিযোগ, গত শনিবার রাত ৩টায় পুলিশ পরিচয় দেওয়া ২০জনেরও বেশি কর্মকর্তা তাঁকে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে তুলে নেয়। এর পর তাঁর ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন।রড দিয়ে তাঁর জয়েন্ট, কাঁধে এবং বিশেষ করে বাঁ পায়ে মারতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়েপড়েন।