বিশ্ব রাজনীতিতে মৌলবাদের উত্থান। আমার পর্যবেক্ষন।

গত ২৭ এপ্রিল ২০১৪ এই কলামে ‘সমকালীন বিশ্ব, রাজনীতি ও ইসলাম’ শিরোনামে ইসলামের পুনর্জাগরণ এবং মৌলবাদী ও চরমপন্থী মুসলিম গোষ্ঠী ও সংস্থাগুলোর উত্থানের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। সেখানে এই দুই প্রক্রিয়ার বিশাল তফাত ও তা বুঝতে ও বোঝাতে অমুসলিম পশ্চিমা পণ্ডিত ও গবেষকদের অপারগতা বা অনীহার কথাও উল্লেখ করেছিলাম। সেই সঙ্গে প্রখ্যাত পশ্চিমা ইসলামী চিন্তাবিদ রোমান ক্যাথলিক ধর্মানুসারী জন এসপজিটোর ইতিবাচক ও মূল্যবান ভাষ্য ও ভূমিকার কথাও উল্লিখিত হয়েছিল। জন এসপজিটো যথার্থই বলেন যে পশ্চিমা সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের অবসানের পর যে পাশ্চাত্য শিক্ষিত ও স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণি দেশ ও সমাজের নেতৃত্ব পায়, তাদের ব্যর্থতা মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ইসলামকে প্রান্তিক অবস্থান থেকে সমাজ ও রাজনীতির মধ্যমঞ্চের দিকে নিয়ে আসে।

আসলে এসব সমাজ থেকে ইসলাম কোনো দিনই অপসৃত হয়নি। পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে প্রভাবিত রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও সমাজের অগ্রণী গোষ্ঠীগুলো সুশাসন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জনকল্যাণ ও উন্নয়নে তাদের কিছুটা সাফল্য থাকার পরও তা যথেষ্ট না হওয়ায় এবং দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জনসাধারণ সরকার ও শাসনব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। অশাসন বা অপশাসনের ফলে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, জননিরাপত্তা ব্যবস্থা হয়ে পড়ে দুর্বল।

প্রাণ, সম্মান ও সম্পদের নিরাপত্তার অভাবে তথাকথিত গণতান্ত্রিক উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের ওপর মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এর ফলেই মুসলিমপ্রধান দেশের ইসলামী মূল্যবোধের যে অরাজনৈতিক পুনর্জাগরণ ঘটে, তাকে বিকৃতভাবে কাজে লাগায় কট্টরবাদী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো। এরাই সৃষ্টি করে সশস্ত্র সন্ত্রাসের। সরকার ও সরকারি দল যতই ভুল পথে চলতে থাকে এবং কুশাসন ও দুর্নীতির ফলে যতই জনসাধারণের মঙ্গল ও উন্নতি আনতে ব্যর্থ হয়, ততই সন্ত্রাসবাদীদের দাপট বাড়তে থাকে।

সুস্পষ্ট ও দৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতির অভাব থাকলে প্রশাসন হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খল, দুর্নীতিবাজ ও দুর্বল। এই সুযোগেই কট্টর ধর্মীয় উগ্রবাদ জোরদার করে তার অগ্রযাত্রা।

এ কথা যে শুধু মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর জন্য সত্য, তাই নয়। প্রধানত অমুসলিম দেশেও এর নজির সাম্প্রতিককালে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ ভারতে রাজনৈতিক কাঠামো, শাসন ও বিচারব্যবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল ও মজবুত থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছুকাল ধরেই ধর্মভিত্তিক বিজেপি হিন্দুত্বকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে।

কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে কোয়ালিশন সরকার দু-দুবার নির্বাচনে জিতে এক দশক ধরে ক্ষমতায় আছে, তার দুর্বল শাসন ও একাংশের প্রবল দুর্নীতি; হিন্দিতে যাকে বলে ভ্রষ্টাচার, তার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে উঠেছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে জনসাধারণের এক অংশ তাই বুঝি হিন্দুত্বের মধ্যে খুঁজে পেতে চাইছে অপশাসন, অবিচার ও দুর্নীতির অবসান।

কিন্তু ইসলামের যে পুনর্জাগরণ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাসহ অন্যান্য এলাকার মুসলমানদের মধ্যে দেখা গেছে, পাশ্চাত্যের পণ্ডিত ও গবেষকরা তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি এবং তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেননি।

সাম্প্রতিক ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে এসপজিটো বলেন, ১৯৭০-এর দশকে আরব ও মুসলিমপ্রধান ও অন-আরব ও অমুসলিম তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো এই গুরুত্বপূর্ণ জৈব জ্বালানির মধ্যে খুঁজে পায় নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি। ১৯৭৩ সালে ‘ইওম কিপুর’ যুদ্ধে মিসর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করে এবং সুয়েজ খালের পূর্বপাড় ও পরে শান্তি চুক্তির ফলে সিনাই উপত্যকা ফেরত পায়। এর পরই আরবরা সৌদি তেলমন্ত্রী জাকি ইয়ামেনির নেতৃত্বে তেলের দাম বাড়ায়। তাদের সঙ্গে অবশ্য পরে অন-আরব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো যোগ দেয়। এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীল পশ্চিমা বিশ্ব প্রথম বিশাল ধাক্কা খায়। কিন্তু এই নতুন বাস্তবতা তারা মেনে নেয়। কারণ তা মোকাবিলা করার যথেষ্ট সম্পদ তাদের কাছে ছিল। চড়া দামে তেল থেকে আহৃত অর্থ সম্পদ যেমন আরব দেশগুলোকে, তেমন ইরানকেও করে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী।

এর পরপরই পশ্চিমা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখে তাদের সমর্থিত পাশ্চাত্যপন্থী শক্তিশালী শাসকদের পতন। ১৯৭৯ সালে ইসলামী পুনর্জাগরণের বিপুল জোয়ারে প্রবল প্রতাপশালী ইরানের শাহান শাহ রেজা শাহ পাহ্লভি সিংহাসনচ্যুত হন। তাঁর জায়গায় সে দেশে কায়েম হয় শিয়া ইসলামী ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ খোমিনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবী সরকার। এই সরকারের পাশ্চাত্য, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব ছিল তীব্র। তেহরানে মার্কিন দূতাবাস অবরোধ ও কূটনীতিকদের পণবন্দি করে রাখা মার্কিনিদের রাজনৈতিক পরাজয়ের এক নতুন নজির সৃষ্টি করে।

পশ্চিমাদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ইরানের শাহান শাহ ছিলেন তাঁদের এক অনুগত মিত্র এবং তাঁর দেশের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের এক অগ্রণী নায়ক। ১৯৭৯ সালে দেশব্যাপী প্রবল ইসলামিক পুনর্জাগরণের জোয়ারে তাঁর ভেসে যাওয়া ছিল পশ্চিমের কাছে এক অকল্পনীয় দুর্ঘটনা।

এসপজিটোর ভাষ্য অনুযায়ী, এই ঘটনা মুসলিমপ্রধান সমাজ ও দেশ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মনে আরো গভীর ও ব্যাপক সংশয় ও ভীতির সৃষ্টি করে। তারা ভাবে যে ইসলামের পুনরুজ্জীবন বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে এবং এর কট্টরপন্থী ও জঙ্গি প্রবক্তা ও সংগঠকরা তৈরি করতে পারে এক প্রবল নয়া অস্থিতিশীলতা। এসপজিটো ১৯৯৯ সালের মধ্য-মার্চের বিকেলে মিনিয়াপোলিসে তাঁর বক্তৃতায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, গড়পড়তা সাধারণ পশ্চিমা মানুষ, খ্রিস্টানরা যে শুধু খ্রিস্টীয় ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে বড় মিলগুলো সম্পর্কে খুব কম জানে অথবা কিছুই জানে না, তাই দুই সমাজকে সংশয় ও সন্দেহে বিচ্ছিন্ন করে না। আরো কিছু সত্যও আছে, যার ফলে পশ্চিমারা জানে না যে তারা ও মুসলিমরা পরস্পর বিপরীতমুখী আলাদা কোনো সত্তা নয়। কারণ পশ্চিমের দুই প্রাণকেন্দ্র ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুসারীদের সংখ্যার হিসেবে ইসলাম যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো ও শর্তাবলি ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন অতি জরুরি।

যে কথা সেদিন এসপজিটো বলেননি, তার গুরুত্বও অনেক। ১৯৯০-এর দশকের প্রথমদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার পূর্ব ইউরোপীয় মিত্রদের, অর্থাৎ পশ্চিমা সমাজতন্ত্রের অবসানের পর পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য শত্রুহীন হয়ে পড়ে। তার অবস্থান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘বসে আছি বন্ধু শূন্য, শত্রু শূন্য, সর্বশূন্য মাঝে’। এই পরিস্থিতি বুঝি পুঁজিবাদের কায়েমি স্বার্থবাদীদের জন্য ছিল অসহনীয়। তাদের দরকার ছিল এক নতুন প্রবল ভীতিকর শত্রুর। ইসলামের পুনর্জাগরণের আভাস ১৯৭০-এর দশক থেকেই দেখে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এ সম্পর্কে সতর্ক ও সরব হয়ে ওঠে।

বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার রাজনীতিতে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি ও বৃহৎশক্তি হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলো নিজের আসন সুরক্ষিত রাখার স্বার্থেই শত্রু খুঁজে বেড়ায়। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌলবাদী আল-কায়েদার অভূতপূর্ব আক্রমণ ‘জঙ্গি ইসলামকে’ এই মহাশত্রুর আসনে বসানোর ব্যাপারে পশ্চিমকে আরো জোরালো প্রেরণা দেয়। সন্দেহ নেই যে সন্ত্রাস ও সহিংসতা শুধু পশ্চিমের নয়, সারা বিশ্বেরই শত্রু। কিন্তু এই শত্রুকে শুধু মুসলিমসমাজের মধ্যেই সীমিত রাখা যুক্তিযুক্ত নয়, মানবিকও নয়। কারণ সব সন্ত্রাসীই যেমন মুসলিম নয়, তেমন সব মুসলিমও সন্ত্রাসী হতে পারে না, হয়ও না। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের উত্থানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণগুলো নতুন রূপে ও সক্রিয়ভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মনে রাখা দরকার, দারিদ্র্য সব দোষের আঁকড়। যেসব মুসলিমপ্রধান দেশে সুশাসন অনুপস্থিত, অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট, দারিদ্র্য প্রবল ও ব্যাপক, সেখানে সাধারণত অসহায় দরিদ্র, বেকার তরুণ-তরুণীদের দীর্ঘ ও বিষণ্ন কাতার থেকে উঠে আসে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জঙ্গিরা। তাদের কাছে ইসলামের শাশ্বত শিক্ষার আলো পৌঁছে না। ইসলামের মানবতাবাদী ও সব মানুষের সম-অধিকার কায়েমের কথাও তাদের অনেকেই পুরোপুরি জানে না, যেমন জানেন না পশ্চিমা পণ্ডিত ও নীতিনির্ধারকরা। অথবা হয়তো জেনেও না জানার ভান করেন। তাই পশ্চিমের নিরাপত্তার নামে যে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ, মারণাস্ত্র, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তারক্ষী গড়ে তোলার কাজে পশ্চিমারা ব্যয় করে, তার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও দরিদ্র মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ব্যয় করে না।

শুধু পশ্চিমকে দোষ দিয়েই বা কী হবে? তেল সম্পদে ধনী বহু মুসলিম দেশের শাসকরা বিলাসে যে সম্পদ অপচয় করেন, তার এক ভগ্নাংশও জনসাধারণের শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে ব্যয় করে না। এই কালো সুড়ঙ্গের পথ ধরেই প্রভাব ও শক্তি বিস্তার করে সংকীর্ণমনা ইসলাম বিকৃতকারী জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। সঠিক শিক্ষা ও আয়-উপার্জনের নৈতিকতাসম্পন্ন উপায়গুলো যদি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো যায়, তাহলে বুঝি দুনিয়াজোড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, তা বিভ্রান্ত ইসলামের নামেই হোক বা অন্য কোনো নামে, এত সবল ও ভীতিকর আকার নিতে পারে না।